• ||
  • Tuesday, April 30th, 2024
  • ||

ইসলামে স্বাধীনতা ও বিজয়োৎসব

ইসলামে স্বাধীনতা ও বিজয়োৎসব

মুফতি আমিন ইকবাল ।।

  • বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় প্রিয় বাংলাদেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে অর্জিত হয় বাঙালি জাতির গৌরবান্বিত বিজয়। ইসলামে স্বাধীনতা অর্জন, বিজয় উদযাপন ও দেশপ্রেমে রয়েছে মহান তাৎপর্য। স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। এর প্রমাণ মেলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানবসন্তান ফিতরাতের (প্রকৃতি) ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ অন্যত্র বলেছেন- ‘প্রত্যেক নবজাতক স্বভাব ধর্মে অর্থাৎ ইসলাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তার পিতা-মাতা তাকে বিভিন্ন ধর্মে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে (ইয়াহুদ, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজক বানায়)।’ (বুখারি, হাদিস : ১৩১৯)
  •  
  • হাদিসে বর্ণিত ফিতরাত বা প্রকৃতির মধ্যেই স্বাধীনতার মর্মকথা নিহিত। মূলত স্বাধীনতা একটি ব্যাপক প্রত্যয়, যার প্রকৃতি অবর্ণনীয়। স্বাধীনতা মানুষের অস্তিত্বে লালিত সুপ্ত প্রতিভা ও শক্তিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধির পথে বিকশিত করতে সহায়তা করে। প্রত্যেক মানুষ চায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে। তাই মানুষের মনকে কোনো খাঁচায় বন্দি করা যায় না; আবদ্ধ রাখা যায় না মানুষের চিন্তা ও চেতনা।
  •  
  • হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি। তাই তিনি মদিনাকে স্বাধীন করেন মুনাফিকচক্র এবং সুদখোর, চক্রান্তবাজ ও ইহুদিদের কবল থেকে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যে কতটা স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এর পরিচয় মেলে পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধে। মদিনার ইহুদি জাতির প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশরা যখন মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়, তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে সাহাবি হজরত সালমান ফারসির (রা.) পরামর্শক্রমে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করেন। মুসলমানরা যাতে এ কাজে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয় সে জন্য তিনি নিজেও পরিখা খননের কাজে অংশ নেন। কুরাইশ বাহিনী পরিখা পার হয়ে মদিনায় আসতে না পেরে কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর ব্যর্থ মনে মক্কায় ফিরে যায়। সে সময় এটা ছিল স্বাধীনতা সুরক্ষায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি বিস্ময়কর পদক্ষেপ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে অনুসরণ করে আমরাও বহু রক্ত, জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে পরাধীনতা আর গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে ছিনিয়ে আনি স্বাধীনতার লাল সূর্য। অর্জন করি লাল-সবুজের বিজয়মালা। এ বিজয় স্বাধীনচেতা মানুষের। এ বিজয় অবহেলিত-নিষ্পেষিত মজলুম জনতার।
  •  
  • দুই 
  • আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। বিজয় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। যেকোনো নেয়ামত প্রাপ্তিতে মানুষ মাত্রই আনন্দিত হয়। আমরাও যারপরনাই আনন্দিত। কিন্তু আনন্দের অতিশায্যে বিজয় উৎসব করতে গিয়ে অনেকেই আল্লাহকে ভুলে যায়। হারিয়ে যায় কোরআন-সুন্নাহবিবর্জিত অপসংস্কৃতির অতল গহ্বরে, যা আদৌ ইসলাম সমর্থন করে না।
  • মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘আল ফাতহ’ তথা বিজয় শিরোনামে একটি সুরা নাজিল করেছেন। বিজয় কীভাবে উদযাপন করতে হয় সে বিষয়েও কোরআন-সুন্নাহে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সুরা নাসরের মধ্যে আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য ও বিজয় আসবে তখন মানুষদের তুমি দেখবে, তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। অতঃপর তুমি তোমার মালিকের প্রশংসা করো এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করো; অবশ্যই তিনি তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা নাসর : ১-৩)
  •  
  • এ সুরায় আল্লাহ তায়ালা বিজয় অর্জনের পর আমাদের দুটি কাজ করতে বলেছেন। এক. বিজয় অর্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে তাঁর দরবারে সদাসর্বদা শোকরিয়া জ্ঞাপন করা। দুই. আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে সবসময় ক্ষমা প্রার্থনা করা। 
  • মনে রাখতে হবে, যে আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেছেন, সেই আল্লাহ আবার আমাদের এ বিজয় যেকোনো সময় কেড়ে নিতে পারেন। আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী) তুমি বলো, হে রাজাধিরাজ (মহান আল্লাহ), তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে সাম্রাজ্য দান করো, আবার যার কাছ থেকে চাও তা কেড়েও নাও, যাকে ইচ্ছা তুমি সম্মানিত করো, যাকে ইচ্ছা তুমি অপমানিত করো; সব রকমের কল্যাণ তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ; নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান।’ (সুরা আলে ইমরান : ২৬)
  • অতএব, বিজয়ের নেয়ামত হারানোর আগেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং তাঁর বিধানাবলি মেনে দুনিয়ার জীবন কাটাতে হবে।
  •  
  • তিন 
  • একাত্তরে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বিজয় উৎসবও করছি প্রতিবছর। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব কি- আমরা শোষণ-দুর্নীতিমুক্ত জাতি তৈরি করতে পেরেছি? মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছি? না পারিনি। কারণ আমরা যেদিকে তাকাই দেখতে পাই দুর্নীতির মহোৎসব, ক্যাসিনো বাণিজ্য, সুদ-ঘুষের বাণিজ্য, নির্যাতন, যত্রতত্র খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, সবলের দ্বারা দুর্বল নির্যাতনের শিকার। তাই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ধর্মপরায়ণতা ও দেশপ্রেম নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামই মানুষের মৌলিক অধিকার ও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।
  •  
  • চার
  • ইসলামে দেশপ্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে স্বদেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শ ও স্বভাব-চরিত্রে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তিনি নিজের মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বিতাড়িত হয়ে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকিয়ে কাতরকণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (তিরমিজি : হাদিস ৩৯২৬)
  •  
  • দেশ, মাটি ও মাতৃভূমি যেমনি পবিত্র ও মর্যাদাবান তেমনি দেশের পতাকাও সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাই দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি দেশের পতাকাকে ভালোবাসতে হবে। আমাদের পতাকার মাঝে যে লাল-সবুজের চিত্র এ তো কেবল রঙ নয়, বরং সবুজ জমিনের ওপর লাখো শহীদের এক বুক রক্ত। এ সবুজ জমিনের ছায়া আর শহীদের রক্তলাল আদর্শের মায়া আমাদের হৃদয়ে জাগ্রত করতে হবে। তবেই দেশ হবে সোনার বাংলা। আর আমরা হব সত্যিকারের আদর্শ দেশপ্রেমিক। 
  •  
  • পরিশেষে আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ, খুন, ধর্ষণ, অবিচার-অত্যাচারসহ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। তা হলেই সুখী-সমৃদ্ধিশালী, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব। এবারের বিজয় দিবসে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
  •  
  • লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
comment
Comments Added Successfully!