• ||
  • Tuesday, April 30th, 2024
  • ||

ইতিহাস-ঐতিহ্যে মহররম ও আশুরা

ইতিহাস-ঐতিহ্যে মহররম ও আশুরা

আরিফ খান সাদ

মুসলমানদের দিন-তারিখ-বর্ষ গণনার অন্যতম মাধ্যম হিজরি বর্ষ। হজরত উমর (রা.) এর যুগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বর্ষ গণনা শুরু হয়। হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। মহররম অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এটাকে সম্মানিত মাস হিসেবে বরণ করা হয়। কারণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ মাসকে সম্মানিত মাসের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন এবং পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির জন্য নির্ধারণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২, যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস; এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তওবা : ৩৬)। হাদিসেও এটাকে ‘শাহরুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর মাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
     
মহররম মাসের দশ তারিখ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। গুরুত্বের কারণে দশ তারিখের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরিচয়জ্ঞাপক শব্দও জন্ম নিয়েছে, যাকে ‘আশুরা’ বা ‘দশম দিবস’ বলা হয়। সৃষ্টিজগতের সৃষ্টির পর থেকে আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা ঘটেছে এবং মহাপ্রলয়সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে বিধায় এই দিনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য অনেক বেশি। আশুরার দিন বা মহররমের ১০ তারিখ যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, সংক্ষেপে সেগুলো হলো– ১. এ দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এ দিনেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। ২. এ দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন। ৩. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। ৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। ৫. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। ৬. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতার সঙ্গে মিলিত হন। ৭. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে। ৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়। ৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ পাক তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন। ১০. মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার অবতারণা হয়। এদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন।
     
 ইসলামের ইতিহাসের এমন সব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো মহররম মাসে সংঘটিত হওয়ার কারণে এ মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাস অতি সম্মানিত, বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। আশুরার এদিনে অনেক নবী-রাসুল আল্লাহ তায়ালার সাহায্য লাভ করেন এবং কঠিন বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এই সাহায্যের শুকরিয়া হিসেবে নবী-রাসুলরা ও তাঁদের উম্মতরা এদিনে রোজা পালন করতেন। এসব ফজিলতের কারণে মুসলমানদেরও বেশি বেশি নফল রোজা রাখতে হয় এবং তওবা-ইস্তেগফার করতে হয়। এ মাসের রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, একবার হজরত আলী (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে কি, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন। হজরত আলী (রা.) বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছেও এক সাহাবি করেছিলেন। তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর তুমি যদি রোজা রাখতে চাও, তা হলে মহররম মাসে রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (তিরিমিজি : ১১৫৭)
     
এ মাসে বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করাও একটি বিশেষ আমল। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মহররম হলো আল্লাহ তায়ালার কাছে একটি মর্যাদাবান মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতীতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি : ৭৪১)। এ দুটো হাদিস এবং উপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহররম মাসের মাহাত্ম্যের অন্যতম কারণ ‘আশুরা’ হলেও পুরো মাসটিই রোজা ও ইস্তেগফারের জন্য বিশেষভাবে বলা হয়েছে। তাই কেবল আশুরা কেন্দ্রিক ইবাদতের অপেক্ষা না করে পুরো মাসটিকেই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ এবং আমলে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। আল্লাহ বোঝার ও আমল করার তওফিক দিন। আমিন।

comment
Comments Added Successfully!