• ||
  • Thursday, May 2nd, 2024
  • ||

আল্লাহ এক কথাটির অর্থ কি?

আল্লাহ এক কথাটির অর্থ কি?

আপনি কি জানেন যে, প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) এর ইসলাম প্রচারের পূর্বেও মক্কার কুরাইশরা সর্বশক্তিমান আল্লাহয় বিশ্বাস করতো? শুধু তাই না, তারা নিজেদেরকে ইব্রাহীম(আ) ও ইসমাইল(আ) প্রচারিত ইসলাম ধর্মের সঠিক অনুসারী বলে মনে করত। প্রিয়নবী মুহাম্মাদ(সা) যখন ইসলাম ধর্মের কথা বলা শুরু করলেন, তারা জিজ্ঞেস করলো – এ আবার কোন্‌ নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছ তুমি? আমরা তো এক আল্লাহ্‌তেই বিশ্বাস করি! আর, তুমি কিনা বলতে চাও আমরা ভুল পথে আছি?

 

জিজ্ঞেস করো, ‘এই পৃথিবী এবং এতে যা আছে তা কার, যদি তোমরা জানো?’ তারা ত্বরিৎ বলবে, ‘তা আল্লাহর’। বলো, ‘তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?’ – (সূরা মু’মিনুন ২৩:৮৪-৮৫)

 

সুতরাং, বুঝাই যাচ্ছে, কুরাইশবাসীরা এক আল্লাহয়  বিশ্বাস করা বলতে যা বুঝতো আর ইসলাম এক

আল্লাহয় বিশ্বাস করা বলতে যা বুঝায় এই দুইয়ের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। ইসলামকে কুফরী থেকে পার্থক্য করার জ্ঞান যদি আমাদের মধ্যে না থাকে, তাহলে আমরাও মুখে বলবো যে হ্যাঁ আমরা এক আল্লাহয় বিশ্বাসী, পাসপোর্টে – বার্থ সার্টিফিকেটে আমাদের ধর্ম হিসাবে ‘ইসলাম’ লেখা থাকবে, কিন্তু আল্লাহর বিচারে আমরা অমুসলিম, মুশরিক হয়ে থাকবো।

 

 তাওহীদ কি?

 

ইসলামে আল্লাহর একত্ববাদের ধারণাকে তাওহিদ বলে। যখনই তাওহীদ লংঘিত হয়, তখনি শিরক হয়। তাই তাওহিদ কে বুঝা আমাদের প্রত্যেকের জন্য খুবই জরুরী। সত্যি বলতে কি, প্রথম নবী আদম(আ) শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মাদ(সা),সবার জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল এই পৃথিবীতে তাওহীদ কে প্রতিষ্ঠা করা।

আলোচনার সুবিধার্থে ইসলামী স্কলারেরা তাওহিদকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। এই তিনরকম তাওহিদের বর্ণনা দিয়েই মহাগ্রন্থ কোরআন শুরু এবং শেষ হয়েছে।

 

১। তাওহিদ আর রবুবিয়াহ  বলে যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হলেন এই সৃষ্টি জগতের রব। অর্থাৎ তিনি এই সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র মালিক, প্রতিপালনকারী, সৃষ্টিকর্তা এবং রক্ষনাবেক্ষনকারী। আমার জীবন, আমার ধন-সম্পদের মালিক আমি নয়, মালিক হলো আল্লাহ – তিনি আমাকে এগুলো ব্যবহার করতে দিয়েছেন মাত্র। আমাদেরকে সূর্য, বাতাস, পানি, চমৎকার এই পৃথিবী দিয়ে আল্লাহ আমাদের প্রতিপালন করছেন। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আর তিনিই গ্রহ-নক্ষত্র সহ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু ও প্রানীকে তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে রক্ষনাবেক্ষণ করে চলেছেন।

 

সমস্ত প্রশংসা সমগ্র সৃষ্টি জগতের রব আল্লাহর জন্য।  (সূরা ফাতিহা:১)

 

বলো, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের রবের কাছে। (সূরা নাস:১)

 

২। তাওহিদ আল আসমা ওয়াসসিফাত এর অর্থ হলো নাম ও বৈশিষ্ট্যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সমকক্ষ আর কেউই নাই।  আল্লাহর নাম ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ(সা) যেভাবে বলেছেন সেভাবেই আমাদের মেনে নিতে হবে। আল্লাহর কোনও বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে থাকলেও এই মিল কেবলমাত্র নামগত, গুণগত নয়। আল্লাহকে আল্লাহ নিজে এবং প্রিয়নবী(সা) যে নাম ও বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়েছেন তার বাইরে নতুন নাম বা বৈশিষ্ট্য দেয়া যাবে না। কোনও সৃষ্ট বস্তু (মাখলুক) কে কোনও বৈশিষ্ট্যে আল্লার সমকক্ষ করা যাবে না।

 

তাঁর সমতুল্য কেউই নাই। – (সূরা ইখলাস ১১২:৪)

 

কোরআনের শুরু হয়েছে আল্লাহর নাম ও গুনাবলী বর্ণনা করে, কোরআন শেষও হয়েছে আল্লাহর নাম ও গুনাবলী বর্ণনা করে।

 

যিনি (আল্লাহ) অনন্ত করুনাময়, পরম দয়ালু। যিনি বিচার দিনের মালিক।  (সূরা ফাতিহা ১:৩-৪)

 

যিনি (আল্লাহ) মানুষের মালিক। (সূরা নাস ১১৪:২)

 

৩। তাওহিদ আল  ‘ইবাদাহ বলতে বুঝায় যে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য আর কারোরই ইবাদত করা যাবে না। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ) এর মতে, যে কোন বিশ্বাস, কথা বা কাজ যা আল্লাহকে খুশী করে তা-ই ইবাদত।

অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামে ইবাদত বলতে শুধু উপাসনা যেমন নামাজ, রোজা, যাকাত ইত্যাদি বোঝায় না। ইসলামে ইবাদত শব্দটির অর্থ অনেক ব্যাপক – ইবাদত বলতে বুঝায় ‘উপাসনা এবং দাসত্ব করা’ । ইবাদত শব্দটি এসেছে ‘আব্দ’ শব্দ থেকে। আব্দ শব্দের অর্থ হলো দাস। দাসের কাজ হলো তার প্রভু যা আদেশ করে সেই কাজ সম্পন্ন করা, আর তার প্রভু যা করতে নিষেধ করে সেই কাজ থেকে বিরত থাকা। কাজেই তাওহিদ-আল-ইবাদাহ বলে যে আমরা এক আল্লাহর আদেশ-নিষেধের উপর অন্য কিছুকেই অধিক গুরুত্ব দিব না। আমরা দাসত্ব করব না টাকা-পয়সার, দাসত্ব করব না কামনা-বাসনার, উপাসনা করব না কোনও মূর্তির বা ভাবমূর্তির। আমরা উপাসনা করব, দাসত্ব করব, আদেশ-নিষেধ মানব তথা ইবাদত করব শুধুই এক আল্লাহর।

 

যিনি (আল্লাহ) মানুষের উপাস্য। (সূরা নাস ১১৪:৩)

 

আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। (সূরা ফাতিহা ১:৫)

 

তাওহিদ-আল-‘ইবাদাহ imply করে তাওহীদ-আর-রবুবিয়াহকে। কারণ, আপনি তারই দাসত্ব কবুল করেন যাকে আপনি আপনার রব বা provider মনে করেন।  কিন্তু , তাওহিদ-আর-রবুবিয়াহ মোটেই তাওহিদ-আল-‘ইবাদাহকে imply করে না। কারণ, কোনো মানুষ কাউকে  provider হিসাবে স্বীকার করার পরেও তার অবাধ্য হতে পারে। উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাপারটা বুঝা যাক।  আপনি অফিসে আপনার বসের সব কথা মেনে চলেন, তিনি যা করতে বলেন তা করেন, যা করতে নিষেধ করেন তা করেন না, আপনি তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন – আপনার এসব কর্মকান্ডই প্রমাণ করে যে আপনি তাকে আপনার provider মনে করেন। অন্যদিকে, এমন হতে পারে যে আপনি থাকেন আপনার বাবার হোটেলে, আপনি ভালই জানেন যে আপনার provider আপনার বাবা, কিন্তু তারপরেও আপনি তার আদেশ-নিষেধ শুনেন না – পড়াশুনা ঠিক মতো করেন না, তার অপছন্দের মেয়ের সাথে প্রেম করেন, তবু মাস শেষে তিনি আপনাকে  হাত খরচ ঠিকই দিয়ে যান।

 

রাসূলুল্লাহ(সা) সুনান আবু দাউদের হাদিসে বলেছেন যে, ‘দু’আই হলো ইবাদত’। দু’আ শব্দটি এসেছে ‘দা’আ’ থেকে, যার অর্থ হলো ডাকা। কাজেই যখনই আমরা কোন গায়েবি কিছুকে ডাকব, তখনই আমরা সেই শক্তির কাছে আসলে দু’আ করছি, আর কারো কাছে দু’আ করা মানেই তার ইবাদত করা। তাওহীদ আল ‘ইবাদাহ বলে যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কোন গায়েবী শক্তিকেই আমরা সাহায্যের জন্য ডাকতে পারব না।

 

ইসলাম ধর্মে আল্লাহ্‌ এক বলতে উপরের তিন রকমের তাওহিদেই আল্লাহর একত্ববাদকে বুঝায়। এখন কেউ যদি বলে সে এক আল্লাহর উপর ঈমান (বিশ্বাস) এনেছে, তার প্রমান কি? প্রমান হলো তার কর্মে। যেমন, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে আপনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়। প্রমান কি? প্রমান হলো যে আপনি আগুন জ্বলতে দেখলে হাত সরিয়ে নেন, কোনো বাচ্চাকে আগুনের দিকে দৌড়ে যেতে দেখলে সর্বশক্তি দিয়ে আপনি তাকে বাঁচাতে যাবেন, তাই না?

 

এবার তাহলে নিজের আমলনামার দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, এক আল্লাহর উপর আসলে আপনি ঠিকভাবে ঈমান (বিশ্বাস) এনেছেন কিনা? আল্লাহর রবুবিয়াহতে ঈমান আনলে আপনি বিশ্বাস করবেন যে আপনার প্রান, সম্পদ, সময়, সন্তান থেকে শুরু করে সবকিছুই আল্লাহ্‌ আপনাকে কিছুদিনের জন্য ধার দিয়েছেন মাত্র, সময় হলেই নিয়ে নিবেন। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও নামাজের ওয়াক্ত হলে নামাজে দাড়িয়ে যাবেন, যাকাতের টাকা খরচ করতে কুন্ঠাবোধ করবেন না। আল্লাহর আসমা ওয়াসসিফাতে ঈমান আনলে সবকিছুতেই মনে মনে আল্লাহকে ডাকবেন কারণ আপনি বিশ্বাস করেন আল্লাহ্‌ আল-সামি’ (সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রবণকারী), আল্লাহকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কটাক্ষও সহ্য করতে পারবেন না কারণ আপনার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আল-কুদ্দুস (সবচেয়ে পবিত্র), বার বার তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবেন কারণ আপনি বিশ্বাস করেন তিনি আল-‘আফুউ অর্থাৎ যিনি শুধু ক্ষমাই করেন না বরং আগের অপরাধের দাগগুলো পুরোপুরি মুছে ফেলেন! তাওহীদ আল ‘ইবাদায় ঈমান আনলে আপনি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন, সততার সাথে কাজ করবেন, মিথ্যা কথা বলা, সুদ-ঘুষ থেকে দূরে থাকবেন শুধু আল্লাহকে খুশী করার জন্য, মানুষের থেকে প্রতিদান পাওয়ার জন্য না।

 

তাওহীদ আল ‘ইবাদায় ঈমান আনার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা – কারণ এটা আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সবচেয়ে বড় হুকুম। আপনি যদি কোনও কোম্পানীতে টাইপিষ্ট হিসাবে চাকরী পেয়ে থাকেন, আর আপনার বসের দেয়া সবচেয়ে বড় হুকুমটাই (টাইপ করা)  পালন না করেন, তাহলে কি আর চাকরী থাকবে?  

 

সূত্র:

১। তাওহীদের মূল নীতিমালা – ড. আবু আমিনাহ্‌ বিলাল ফিলিপ্স

২। Fundamentals of Faith – Dr. Yasir Qadhi

৩। Replacements – Lesson from Surah AL-Ikhlas – Nouman Ali Khan

comment
Comments Added Successfully!