• ||
  • Thursday, May 2nd, 2024
  • ||

ভ্রমণে ইবাদতের সুযোগ

ভ্রমণে ইবাদতের সুযোগ
  • ভ্রমণ একটি আনন্দময় ইবাদত এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার উৎস। সফর বা ভ্রমণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো পূর্ববর্তীদের কীর্তি ও পরিণতি সম্বন্ধে জানা ও শিক্ষা গ্রহণ করা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল তা কি দেখে না? যারা মুত্তাকি তাদের জন্য পরলোকই শ্রেয়; তোমরা কি বোঝো না?’ (সুরা ইউসুফ : ১০৯)। আরও বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না ও দেখে না তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল? পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক এবং শক্তিতে ও কীর্তিতে অধিক প্রবল। তারা যা করত তা তাদের কোনো কাজে আসেনি।’ (সুরা মুমিন : ৮২)।
  •  
  • আল্লাহর তায়ালার অপরূপ সৃষ্টি এ বিশ্বজগৎ অভাবনীয় বিস্তীর্ণ। পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, দিক-দিগন্তজুড়ে কত দেশ, নগর, সভ্যতা ও কত রঙ-বেরঙের মানুষ আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভ্রমণ মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। জ্ঞানের দুয়ার খোলে দেয়। ভ্রমণের মাধ্যমে ভিন্ন ভাষার ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। মানুষের জীবনও একটি অনন্ত ভ্রমণের অংশবিশেষ। মানুষ অনন্ত সফরের যাত্রী। এই ভ্রমণের সূচনা হলো আমলে আরওয়াহ বা রুহের জগৎ থেকে। এর দ্বিতীয় ধাপ হলো আলমে দুনিয়া তথা দুনিয়ার জীবন। তৃতীয় সোপান হলো আলমে বারজাখ বা অন্তর্বতীকালীন জীবন, যা মৃত্যুর পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত বিস্তৃত। এরপর আখেরাত বা পরকালের অনন্ত জীবন। পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য অনুধাবনের জন্য ভ্রমণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে বলেন, ‘আপনি তাদের বলুন, তোমরা পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করো এবং দেখো তিনি কীভাবে সৃষ্টির সূচনা করেছেন, তারপর আল্লাহ এসবকে আবার জীবন দান করবেন। অবশ্যই আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।’ (সুরা আনকাবুত : ২০)
  •  
  • ভ্রমণকারীর যেন ইবাদত-বন্দেগিতে কষ্ট না হয় এজন্য ইসলামে ‘কসর’ বা চার রাকাতের নামাজ দুই রাকাত পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং রোজা না রেখে পরবর্তী সময়ে কাজা করার ইখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এমনকি ভ্রমণকারী অর্থকষ্টে যেন না ভোগে, তাই তাকে জাকাত দেওয়ারও হুকুম করা হয়েছে। আর কোনো কাজে এতটা সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই কারণে অনেক ইসলাম বিশেষজ্ঞ বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রমণ কেবল বৈধ নির্দেশ নয় বরং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইবাদত। এ জন্য ইসলামের ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, মুসলিমরা জ্ঞান অন্বেষণে দূরদূরান্তে ভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর যেখানেই কোনো উপকারী জ্ঞান পেয়েছেন, তাকে ধারণ করে নিজ জাতির উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছেন। একই সঙ্গে নিজেরাও ছড়িয়েছেন বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তিময় বাণী ও সভ্যতা। এ জন্য খুব কম সংখ্যক সাহাবির কবর আরব ভূখণ্ডে পাওয়া যায়। আটলান্টিকের এই পার থেকে শুরু করে সুদূর চীনের নানা জায়গায় সাহাবিদের কবর। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত তারা দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণে ও সফরে কাটিয়েছেন।
  •  
  • ভ্রমণের পথ যেন চোর-ডাকাত থেকে মুক্ত থাকে, সে জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর শাসনব্যবস্থায় জোর তাগিদ দেন। পরবর্তী খলিফারাও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। হজরত আদি ইবনে হাতিম তাই (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মজলিসে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি এসে দুর্ভিক্ষের অভিযোগ করল। তারপর আরেক ব্যক্তি এসে ডাকাতের উৎপাতের কথা বলে অনুযোগ করল। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে আদি, তুমি কি হিরা নামক অঞ্চলে গিয়েছ?’ আমি বললাম, না, যাইনি; তবে অঞ্চলটি সম্পর্কে জানি। তিনি বললেন, ‘তুমি যদি দীর্ঘজীবী হও তবে দেখতে পাবে- একজন উট সওয়ার হাওদানশিন নারী হিরা অঞ্চল থেকে রওয়ানা হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করে যাবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় করবে না।’ আদি (রা.) বলেন, নবীজির ইন্তেকালের অনেক বছর পর আমি নিজে দেখেছি, এক উট সওয়ার নারী হিরা থেকে একাকী রওয়ানা হয়ে এসে কাবাঘর তাওয়াফ করে গেছে।’ (বুখারি : ৩৩৪০)
  •  
  • ভ্রমণ কেবল মানুষকে নতুন কিছু দেখায় না, নিজেকে ও সঙ্গী-সাথীদের চিনতে সাহায্য করে। ভ্রমণের কারণে মানুষ ধৈর্যশীল হয়, সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। ভ্রমণের সবচেয়ে উপকারী দিক হলো অভিজ্ঞতা। হজরত মুআবিয়া (রা.) বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রজ্ঞাবান হওয়া যায় না। যদিও সাবধানতা গ্রহণ করা উচিত, তবু বলতে বলতে হয় ভ্রমণে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়, এর মধ্যে অনেক প্রতারকও থাকে, কখনও কখনও তাদের খপ্পরে পড়ে যেতে হয়, সেখান থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন এক গর্তে দুবার দংশিত হয় না।’ (বুখারি : ২৫১৬)। ইসলাম প্রতারিত হওয়াটাকেও শিক্ষায় রূপান্তর করতে বলে।
  •  
  • ভ্রমণের অনেক নিয়মকানুন আছে, অবস্থান ভেদে নিয়মকানুন ভিন্ন হয়, সেগুলো মান্য করা। বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করা। ভ্রমণে বের হওয়ার আগে আল্লাহর রাসুল (সা.) এই দোয়া করতে বলেছেন- ‘আল্লাহর নামে বের হচ্ছি; আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো উপায় নেই; আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তিও নেই।’ (তিরমিজি : ৩৪২৬)। যেহেতু সফর একটি বিধিবদ্ধ ইবাদত, তাই সফরের রয়েছে বিশেষ কিছু বিধিবিধান। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় সফর বলা হয়- আপন বাসস্থান থেকে বা কর্মস্থল থেকে আটচল্লিশ মাইল বা সত্তর কিলোমিটার দূরত্বে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মহল্লা বা গ্রাম থেকে বের হওয়া। গন্তব্যে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সফর অবস্থা বহাল থাকে। সফর বা ভ্রমণকারীকে মুসাফির বলা হয়। গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র হয়, তবে সেখানে পৌঁছার পর আর মুসাফির থাকবেন না। আর গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র না হয় এবং সেখানে অন্তত ১৫ দিবস রজনী থাকার নিয়ত বা ইচ্ছা না থাকে, তাহলে সফর অবস্থা বহাল থাকবে।
  •  
  • সফরে দোয়া কবুল হয়। সফরকালীন চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ কসর, অর্থাৎ দুই রাকাত পড়তে হয় এবং সুন্নত নামাজ নফল পর্যায়ভুক্ত হয়। সফর অবস্থায় প্রয়োজনে ফরজ রোজা পরে রাখা যায়। সফর অবস্থায় ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ এবং কোরবানি ওয়াজিব হয় না। তবে সুযোগ থাকলে আদায় করা উত্তম। আল্লাহ আমাদের বেশি বেশি ভ্রমণ করার এবং ভ্রমণ থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
  •  
  • লেখক: সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা
     
comment
Comments Added Successfully!