• ||
  • Thursday, May 2nd, 2024
  • ||

হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মাওলানা শোয়াইব রিফাত

  • ইসলামের মৌলিক ভিত্তি পাঁচটি। কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ এবং জাকাত। এর মধ্যে কিছু আমল কেবল শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। যেমন নামাজ-রোজা। এ দুটি পালন করতে অর্থ বা টাকা পয়সার প্রয়োজন হয় না। আবার কিছু আমল আছে কেবল অর্থ দিয়ে পালন করা যায়। যেমন জাকাত। এটি পালন করতে শারীরিক শ্রমের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে হজ এমন আমল- যা পালন করতে অর্থ এবং শ্রম দুটোরই প্রয়োজন হয়। ফলে এই আমলের গুরুত্ব ও তাৎপর্যও আলাদা। 
  • যারা আর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থ্যবান তাদের ওপর সারা জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে শরিয়তের নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান তথা বায়তুল্লাহ এবং সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ নির্ধারিত কাজের মাধ্যমে সম্পন্ন করাই ইসলামের পরিভাষায় হজ।
  •  
  • হজের ইতিহাস
  • আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। এর পর থেকে নবী-রসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ পালনের বিধানটি। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন কাবাঘর। উল্লেখ্য, কাবাঘরটি হজরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন।
  • হজরত ইবরাহিম জিবরাইল (আ.)-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি নির্দেশ হলো হজব্রত পালনের। আল্লাহতায়ালা হজরত জিবরাইল (আ.) মারফত তাঁকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম। এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেওয়ার।
  • হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যখন হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেওয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ বললেন, তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেওয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার। এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) তখন মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন।’ এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে। এ হজ দ্বারা স্থাপিত হলো বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য।
  •  
  • হজের গুরুত্ব 
  • এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ওই ব্যক্তির ওপর ফরজ করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা অস্বীকার করে (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহ জগদ্বাসী থেকে মুখাপেক্ষীহীন।’ (আলে ইমরান )। তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও ওমরাহ পূর্ণ কর। কিন্তু যদি তোমরা বাধাপ্রাপ্ত হও, তাহলে যা সহজলভ্য হয়, তাই কুরবানি কর।’ (বাকারা)। 
  • নবী (সা.) একাধিক হাদিসে হজের ফজিলতের বিষয় আলোচনা করেছেন। ইবনু ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপরে প্রতিষ্ঠিত (১) তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল (২) নামাজ কায়েম করা (৩) জাকাত প্রদান করা (৪) হজ সম্পাদন করা ও (৫) রমজানের রোজা পালন করা।’
  • আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে। যার মধ্যে সে অশ্লীল কথা বলেনি বা অশ্লীল কার্য করেনি, সে হজ থেকে ফিরবে সেদিনের ন্যায় (নিষ্পাপ অবস্থায়) যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন।’ অর্থাৎ সে কাবীরা-ছাগীরা, প্রকাশ্য-গোপনীয় সকল গুনাহ থেকে ঐরূপ মুক্ত হয়ে ফিরে আসে। যেরূপ একজন শিশু গুনাহ মুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে।
  •  
  • যমযমের পানি পান করার ফজিলত
  • তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত নামাজ শেষে মাত্বাফ থেকে বেরিয়ে পাশেই যমযম কুপ। সেখানে গিয়ে যমযমের পানি বিসমিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে পান করবে ও কিছুটা মাথায় দিবে। যমযমের পানি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে সেরা পানি হলো যমযমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ মুক্তি। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটি বরকতময়।’ রাসূল (সা.) আরো বলেন, ‘এই পানি কোন রোগ থেকে আরোগ্যের উদ্দেশ্যে পান করলে তোমাকে আল্লাহ আরোগ্য দান করবেন। এটি পানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহ তোমাকে আশ্রয় দিবেন। আর তুমি এটা পরিতৃপ্তি বা পিপাসা মিটানোর জন্য পান করলে আল্লাহ সেটিই করবেন।’
  •  
  • বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক
  • হজ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঐক্যসম্মিলন, অন্য কোনো কারণে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান কখনও একত্রিত হয় না। হজ কেবল ঈমানকে বলিষ্ঠ করে না, বরং এটা সমগ্র মুসলিম জাহানকে ঐক্যবদ্ধ করার পন্থা হিসেবেও কাজ করে। হজের সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল- এই প্রত্যেকটি জিনিসই মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নয়নে সাহায্য করে। বিশ্বের সব এলাকার, সব বর্ণের, সব ভাষার এবং প্রশিক্ষণ ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারিত করে জাতীয়তার প্রাচীরকে করে নিশ্চিহ্ন, সৃষ্টি করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। হজ বিশ্ব মুসলিমের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
  • আর হজ হচ্ছে গোটা মুসলিম মিল্লাতের মহাঐক্যের সম্মেলন, যাতে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার বিভিন্নতা ভুলে এককেন্দ্রিক হওয়ার পথ খুঁজে পায়। এর মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের চিত্র ফুটে ওঠে। এটি মুসলমানদের মধ্যে ইমানি জজবা ও ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করে।
  • উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে দু’বছর যাবত স্বাভাবিক পক্রিয়ায় হজ সম্পন্ন করতে পারছেন না বিশ^বাসী। সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেবল সৌদি আরবের নাগরিক এবং পূর্ব থেকে সে দেশে অবস্থানরত মুসলিমরাই কেবল হজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন দ্রুত এই মহামারি তুলে নেন এবং আবারও কাবা চত্তরে বিশ^বাসীর মিলনমেলার আয়োজন করেন; লাখো কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি তোলার সুযোগ করে দেন। 
comment
Comments Added Successfully!