• ||
  • Thursday, May 2nd, 2024
  • ||

কুরআন রমজানের শ্রেষ্ঠ উপহার

কুরআন রমজানের শ্রেষ্ঠ উপহার

কুরআন ও রমজান-এক ঐশী বন্ধনে আবদ্ধ। অন্যসব মাস এই মিতালী থেকে বঞ্চিত। রমজান আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানবহৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার হয়। সব কেমন সতেজ হয়ে ওঠে। রোজা, নামাজ, দান ও দোয়ার কি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেই দৃশ্যে মধু মেখে যোগ হয় কুরআন তেলাওয়াত। কী ছোট, কী বড়, কী নারী, কী পুরুষ-ছড়িয়ে পড়ে সবার প্রাণে প্রাণে কুরআনের সুবাতাস। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়ে তার সম্মোহনী সৌরভ। কারণ, কুরআন একদিন পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল। আর রমজান তাকে পরম যত্নে বুকে ধারণ করেছিল। এরশাদ হয়েছে, 'রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ...' (সুরা বাকারা : ১৮৫)

তবে এই বিশেষত্ব পুরো রমজানের না। বরং তার শেষ দশকের। আল্লাহ বলেন, আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (সুরা দুখান : ৩)
সে বরকতময় রাত কোনটি? কুরআন তার পরিচয় দিয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যার নাম লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত। আল্লাহ বলেন, আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে। শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।(সুরা কদর : ১,২,৩)
আল্লাহ এই রাতে সর্বপ্রথম লাওহে মাহফুজ থেকে পুরো কুরআন সপ্তাকাশে অবতীর্ণ করেন। তারপর স্থান-কাল-পাত্রভেদে নবীজির উপর ধীরে ধীরে অবতীর্ণ করেন।

রমজানের শ্রেষ্ঠ ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত

পুরো রমজান ইবাদতের মাস। প্রতিটি ইবাদতের রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। তার মাঝে কুরআন তিলাওয়াত অন্যতম। তাইতো রাসূল (সা.) এ মাসে প্রচুর তিলাওয়াত করতেন। জিবরিল (আ.) কে কুরআন শোনাতেন। ইব্‌নু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসূল (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমাযানে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরীল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমাযানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আ.) তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং তারা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন...। (বুখারী : ৬)

নবীজি (সা.) রাতের নামাজের দীর্ঘ কেরাত পাঠ করতেন। হুযাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) এর সঙ্গে এক রাতে নামায পড়লাম । তিনি সূরা বাকারাহ আরম্ভ করলেন । আমি মনে মনে বললাম, একশত আয়াতের মাথায় তিনি রুকু করবেন । (কিন্তু) তিনি তারপরও কিরাআত চালু রাখলেন । আমি মনে মনে বললাম, তিনি এরই দ্বারা (সূরা শেষ করে) রুকু করবেন। কিন্তু তিনি সূরা নিসা পড়তে আরম্ভ করলেন এবং সম্পূর্ণ পড়লেন । তিনি স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন...। (মুসলিম: ৭৭২)

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরআন তিলাওয়াতের অনেক ফজিলত উল্লেখ করেছেন।

১. কোরআনের প্রতি হরফে ১০ নেকি অর্জিত হয় । আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সাওয়াব আছে। আর সাওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, ‘আলিফ-লাম-মিম’ একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মিম একটি হরফ। (তিরমিজি : ২৯১০)

২. কোরআন তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে। আবূ উসামাহ আল বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পাঠ কর। কারন কিয়ামাতের দিন তার পাঠকারীর জন্য সে শাফা’আতকারী হিসেবে আসবে...। (মুসলিম : ১৭৫৯)

রাসূল (সা.) অন্যত্র বলেন, কিয়ামতের দিন সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি ওকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে  আমার সুপারিশ গ্রহণ কর। আর কুরআন বলবে, ‘আমি ওকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।’ নবীজি (সা.) বলেন, অতএব ওদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে'। (আহমাদ : ৬৬২৬)

রমজানে কুরআনের প্রতি আমাদের করণীয়

আল্লাহ তা'আলা মানুষের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। সে জন্য কুরআনের প্রতি মানুষের অনেক হক রয়েছে, রয়েছে অনেক করণীয়। মাহে রমজানে যেগুলো আরো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১. কুরআনুল কারীম শিক্ষা করা।
 প্রতিটি বাবার দায়িত্ব, সন্তানকে ছোটবেলাতেই কুরআনে কারীম শিক্ষা দেয়া। কোন কারণে শেখা না হলে পরে অবশ্যই শিখে নিতে হবে। নামাজ শুদ্ধ হয় পরিমাণ সকল মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ঐ ব্যক্তি, যে ব্যক্তি কুরআন নিজে শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। (আবু দাউদ : ১৪৫২)

২. তিলাওয়াত শুদ্ধ করা। 
পারিবারিকভাবে কিংবা নিজ আগ্রহে অনেকেই কুরআন শিক্ষা করে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়-তিলাওয়াত অশুদ্ধ থেকে যায়। হরফগুলো মাখরাজ থেকে উচ্চারিত হয় না। মদ-গুন্নাহর কোন বালাই নেই। যার ফলে ক্ষেত্রবিশেষ অর্থও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই নামাজ নষ্ট হওয়াসহ মারাত্মক গুনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে। আল্লাহ বলেন, আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে...। (সুরা বাকারা : ১২১)

নবীজি (সা.) এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এসেছে, 'এবং কোরআন পাঠ করুন সুবিন্যস্ত ভাবে ও স্পষ্টভাবে'। (সুরা মুযযাম্মিল : ৪)

৩. কুরআন হিফজ করা; মুখস্থ করা।

 কোরআন হিফজ করা বিরাট সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবের বিষয়। হাদিসে হাফেজে কুরআনের বিশাল মর্যাদার কথা এসেছে। নবীজী (সা.) বলেন, কুরআনের হাফেয পাঠক, লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতার সাথে হাশর করবে। অতি কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কুরআন মাজীদ পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার লাভ করবে। (বুখারী : ৪৯৩৭)

নবী (সা.) আরো বলেছেন, (কিয়ামাতের দিন) কুরআনের বাহককে বলা হবে, পাঠ করতে থাক ও উপরে আরোহণ করতে থাক এবং দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে ঠিক সেরূপে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক। যে আয়াতে তোমার পাঠ সমাপ্ত হবে সেখানেই তোমার স্থান। (তিরমিজি : ২৯১৪)
Abdul
Abdul Aziz
৪. কুরআন খতম করা। 

মুমিনমাত্রই প্রতিনিয়ত কুরআন তিলাওয়াত করবে। অধিকহারে পাঠ করার চেষ্টা করবে। তবে রমজানে অবশ্যই খতম করার আগ্রহ থাকা চাই। কুরআনের ভরা মৌসুমে এটা স্বাভাবিক ভাবেই কাম্য। সাহাবায়ে কেরামসহ পুর্ববর্তী মনিষীগণ রমজানে কুরআন খতমের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। রাতের নামাজে কুরআন খতমের অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত প্রতি যুগেই অহরহ রয়েছে। 
 বিশিষ্ট তাবেয়ী, প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও মুফাসসির ক্বাতাদা ইবনে দিআমা রহ.-এর সাধারণ আমল ছিলো সাতদিনে এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা। আর যখন রমজান মাস উপস্থিত হতো তখন তিনি মাত্র তিনদিনে এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। এরপর রমজানের শেষ দশকের যখন আগমন হতো তখন তিনি প্রতি রাতেই এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবি : ৫/২৭৬)

হাদীস জগতের আমীরুল মুমিনীন ইমাম বুখারী রহ.-এর আমল ছিলো, যখন রমজানের প্রথম রজনীর আগমন হতো তখন তাঁর ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর কাছে একত্রিত হতো। তিনি তাদের নিয়ে তারাবির নামাজ পড়তেন। প্রত্যেক রাকাতে বিশ আয়াত করে পড়তেন। এভাবে নিয়মতান্ত্রিক তারাবির নামাজে কুরআন শরীফ খতম করতেন। অনুরূপভাবে তিনি প্রত্যেক শেষ রাতে কুরআন শরীফের এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। যার ফলে প্রতি তিন রাতের শেষ প্রহরে তিনি  কুরআন খতম করতে পারতেন। এছাড়াও প্রত্যেক দিন এক খতম কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। সাধারণত দিনের খতম তিনি সন্ধ্যায় ইফতারের সময় শেষ করতেন।
(শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৩/৫২৪)

৫. অনুবাদ জানা ও চিন্তাভাবনা করা। 
কুরআনে কারিম পথভ্রষ্ট মানুষের জন্য সুস্পষ্ট হিদায়েতের বার্তা। এই বার্তা তখনই অনুধাবন করা সম্ভব যখন তার অর্থ জানা যাবে। তাই তেলাওয়াত শুদ্ধ করার পর তার অর্থ বোঝার প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্য কর্তব্য। যে ব্যক্তি অর্থ বুঝবে তার পক্ষেই কেবল আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সহ হিদায়াতের প্রতিটি বাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করা সম্ভব। আল্লাহ কুরআনের বহু স্থানে তাঁর নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন, 'কুরআন বরকতপূর্ণ ঐ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি, যাতে কুরআনের আয়াতগুলোকে নিয়ে তারা চিন্তা করে। (সূরা সদ : ২৯)
অপর আয়াতে বলেন, 'তারা কি কুরআন নিয়ে ভাবে না?' (সুরা নিসা : ৮২)

৬. কুরআন অনুযায়ী জীবন গড়া।
 এটা হল মানব জাতির উপর কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য। কুরআন মোতাবেক জীবন গড়লেই প্রকৃত মানুষ বনা সম্ভব। রাসূল (সা.) ছিলেন কুরআনের প্রতিবিম্ব-আয়না। সাহাবায়ে কেরাম সে আয়নায় নিজেকে গড়েছেন। কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন। ফলে তাঁরা মহান থেকে মহান মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যে বা যারাই কুরআনের আয়নায় নিজেকে দেখেছে, জীবনের মোড়ে মোড়ে কোরআনকে মাইলফলক হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারাই লক্ষ্যপানে পৌঁছেছে। মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়, ইতিহাসের পাতায় পাতায় সোনার হরফে অমর হয়ে আছে তারা। এবং কিয়ামত অবধি থাকবেন কোন সন্দেহ ছাড়া।

অতএব, এখনই সময় দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করার, কুরআন শিক্ষা করব। শুদ্ধ ভাবে তিলাওয়াত করব‌। অর্থ ও মর্ম বুঝে চিন্তা ভাবনা করব। এবং অবশ্যই নিজের জীবনকে কুরআনের রঙে রাঙাবো। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

comment
Comments Added Successfully!