• ||
  • Thursday, May 2nd, 2024
  • ||

জাকাত কীভাবে দেবেন, কাকে দেবেন?

জাকাত কীভাবে দেবেন, কাকে দেবেন?

মুফতি আমিন ইকবাল 

পবিত্র কোরআনে নামাজের পর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাকাতের বিধানকে। মহান আল্লাহ জাকাতকে ‘বঞ্চিত ও মুখাপেক্ষীর অধিকার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুমিনদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ‘তারা এমন লোকÑ যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে, সৎকাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজে বাধা প্রদান করে।’ (সুরা হজ : আয়াত ৪১)।
জাকাত অর্থ পবিত্র হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। এ জন্য জাকাতকে সুদবিহীন দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের বাহন এবং নিজের অর্জিত সম্পদ পবিত্র করার মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জাকাত দেওয়ার আবশ্যক। জাকাতের টাকায় অসহায়-গরিবরা স্বচ্ছল হবেন; স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করবেন। অবশ্য সবার ওপর জাকাত ফরজ না, আবার যে কাউকে জাকাত দেওয়াও যাবে না। কোরআনে বর্ণিত নির্ধারিত খাতেই জাকাতের টাকা পরিশোধ করতে হবে। 

জাকাত কাদের ওপর ফরজ
যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছেÑ এমন স্বাধীন ও পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারী জাকাত আদায় করবে। কারণ, তাদের ওপর জাকাত ফরজ। তবে এর জন্য শর্ত হলোÑ এক. সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ মালিকানা থাকতে হবে। দুই. সম্পদ উৎপাদনক্ষম ও বর্ধনশীল হতে হবে। তিন. নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। চার. সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই শুধু জাকাত ফরজ হবে। পাঁচ. ঋণমুক্ত হওয়ার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে। ছয়. কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর থাকলেই শুধু ওই সম্পদের ওপর জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের নিসাব
স্বর্ণ-রৌপ্য, নগদ টাকা, ব্যবসায়ী পণ্য, গবাদি পশু এবং কৃষি ফসলের জাকাত দিতে হয়। নিচে কোনটার কী নিসাবÑ উল্লেখ করা হলো।
স্বর্ণ-রৌপ্যের নিসাব
স্বর্ণের নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি (তোলা)। রৌপ্যের নিসাব হলো সাড়ে বায়ান্ন ভরি (তোলা)। স^র্ণ ও রৌপ্য উভয়টি যদি কারও কাছে থাকে এবং এর কোনোটাই নিসাব পরিমাণ না হয়; তবে উভয়টির মূল্য হিসাব করে দেখতে হবে। মূল্য যদি একত্রে রূপার নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, অর্থাৎ ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের সমান হয়ে যায়, তবেই জাকাত আদায় করতে হবে। 
নগদ টাকার নিসাব
নগদ টাকার নিসবা হলো, বাজার দর হিসাবে অন্তত সাড়ে ৫২ ভরি রূপার মূল্যের পরিমাণ টাকা এক বছরকাল জমা থাকলে এর জাকাত আদায় করতে হবে। হাতে ও ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র, সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেট ইত্যাদি নগদ অর্থ বলে গণ্য হবে।
ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব
ব্যবসায়ী পণ্যের নিসাব হলো, কোনো জিনিস বিক্রি করার উদ্দেশ্যে রাখা হলে তাকে ব্যবসার পণ্য মনে করা হবে। সাড়ে ৫২ ভরি রূপার মূল্যের সমান মূল্যমান সম্পন্ন ব্যবসার পণ্যের জাকাত দিতে হবে। বছরান্তে তখনকার বাজারদর হিসেবে মূল্য ধরতে হবে। খরিদ মূল্য ধরলে চলবে না।
কৃষি ফসসেলর নিসাব
কৃষি ফসলের ক্ষেত্রে প্রতিটি শ্রেণির ফসলের নিসাব পৃথক পৃথকভাবে হিসাব করে নিসাব পরিমাণ ফসল হলে উশর দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ধান যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, পাট  যদি ৩০ মণ বা তার বেশি হয়, তাহলে ফসল তোলার সময়ই তার উশর দিতে হবে। তেমনিভাবে কলাই, সরিষা, মধু ইত্যাদি প্রতিটির নিসাব পৃথকভাবে ধরতে হবে। খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো নিসাব নেই। খনিজ সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় থাকলে সম্পদ উত্তোলনের পরই হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। খনিজ সম্পদের জাকাতের হার হচ্ছে ২০ শতাংশ।
গবাদি পশুর জাকাত 
নিজের কাজে খাটে এবং বিচরণশীল বা ‘সায়েমা’ নয় এমন গরু-মহিষ বাদ দিয়ে ৩০টি হলেই তার ওপর জাকাত দিতে হবে। জাকাতের হার হবে প্রতি ৩০টির জন্য একটি এক বছর বয়সের গরু এবং প্রতি ৪০টি বা তার অংশের জন্য দুই বছর বয়সের একটি গরু। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪০টি হলে একটি, ১২০টি পর্যন্ত দুটি, ৩০০টি পর্যন্ত তিনটি এবং এর ওপরে প্রতি ১০০টি ও তার অংশের জন্য আরো একটি করে ছাগল জাকাত দিতে হবে।

জাকাত আদায় ফরয হওয়ার একটি মৌলিক শর্ত হলোÑ স্বর্ণ, রূপা, টাকা-পয়সা বা ব্যবসার পণ্য নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর তৎক্ষনাৎ জাকাত আদায় করা ফরয হয় না; বরং এক বছরকাল নিজের মালিকানাধীন থাকলেই জাকাত আদায় করা ফরয হয়। অতএব নিসাব পরিমাণ হওয়ার সাথে এক বছর অতিক্রান্ত হওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
বছরের শুরুতে যদি নিসাব পরিমাণ মাল বা টাকা-পয়সা থাকে আর বছরের মধ্যবর্তী সময় নেসাবের চেয়ে কম হয়, আবার বছরের শেষাংশে নেসাবের পরিমাণ হয়ে যায় অথবা বছরের মধ্যবর্তী সময় আরও বৃদ্ধি পায় উভয় অবস্থাতেই বছরান্তে যে পরিমাণ মাল বা টাকা থাকবে তার জাকাত হিসাব করে আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, বছরের শেষে কি পরিমাণ থাকে তাই ধর্তব্য। মধ্য বছরের হ্রাস-বৃদ্ধি ধর্তব্য নয়।

জাকাতের পরিমাণ
সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ জাকাত আদায় করতে হয়। জাকাত ফরজ হওয়া মালের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে এর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকরা আড়াই টাকা জাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। সামান্য কম হলেও জাকাত আদায় হবে না। জাকাত টাকা একজনকে দেওয়া যায়, আবার একাধিক জনের মাঝে বন্টন করেও দেওয়া যায়। তবে জাকাতের নামে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি দেওয়া ঠিক না। বরং অসহায় মানুষকে জাকাতের টাকায় সামলম্বি করে তোলাই হোক লক্ষ্য।   

কোন কোন সম্পদের জাকাত দিতে হবে না
১. নিজ ও পোষ্য পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর জাকাত ফরজ নয়। 
২. গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি ইত্যাদি এবং গার্হস্থ সামগ্রী যেমন হাড়ি-পাতিল, থালা-বাটি, গ্লাস ইত্যাদির ওপর জাকাত ফরজ নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেনো। 
৩. পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে জাকাত ফরজ হবে না। 
৪. দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর জাকাত ফরজ নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর জাকাত ফরজ হবে।
৫. ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের ওপর জাকাত আসবে 
৬. ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর-বাড়ি বা অন্য কোনো সামগ্রী যেমন ডেকোরেটরের বড় বড় ডেগ, থালা-বাটি ইত্যাদি ক্রয় করলে তার ওপরও জাকাত ফরজ নয়। তবে ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত অর্থের উপর জাকাত আসবে।

কাদেরকে জাকাত দেওয়া যাবে
আট শ্রেণির লোকদেরকে জাকাত দেওয়া যাবে। পবিত্র কোরআনের সুরা তওবার ৬০ নং আয়াতে তাদের কথা উল্লেখ রয়েছে। তারা হলেনÑ
১. ফকির। বাংলায় তাদেরকে গরীব বলা হয়।
২. মিসকিন। যাদের আর্থিক অবস্থা গরীবদের চেয়েও খারাপ, তারাই মিসকিন।
৩. আমেল। জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি।
৪. মন জয় করার জন্য। ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করা বা ইসলামের সহায়তার জন্য কারো মন জয় করার প্রয়োজন হলে তাকে জাকাত দেওয়া যাবে। ইসলামের শুরুর দিকে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। বর্তমানে এই খাতের খুব একটা প্রয়োজন নেই। তবে নওমুসলিমদের সমস্যা দূর করার জন্য জাকাত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা যাবে।
৫. দাস মুক্তি। তথা দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ লোক এবং ইসলামের জন্য বন্দিদের মুক্ত করাতে তাদের জন্য জাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে।
৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ। ঋণভারে জর্জরিত লোকেরা মানসিকভাবে সর্বদাই ক্লিষ্ট থাকে এবং কখনো কখনো জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের ঋণমুক্তির জন্য জাকাতের টাকা দেওয়া যাবে।
৭. আল্লাহর পথে ব্যয়। কোরআনের ভাষায় এ খাতের নাম বলা হয়েছে ‘ফি সাবিলিল্লাহ’, যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর পথে। আল্লাহর পথে কথাটি খুব ব্যাপক। মুসলমানদের সব নেক কাজ আল্লাহর পথেরই কাজ।
৮. মুসাফির। মুসাফির বা প্রবাসী লোকের বাড়িতে যত ধন-সম্পত্তিই থাকুক না কেন, পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাকে জাকাত তহবিল হতে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া যাবে।

জাকাত না দেওয়ার শাস্তি
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশ কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তিলাওয়াত করেন, ‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য কিয়ামত দিবসে, অচিরেই অকল্যাণকর হবে যা কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে।’ (বুখারি : হাদিস ১৩২১)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে সম্পদের জাকাত দেয়া হয়নি তাকে বিষধর সাপে রূপান্তর করে ওই সম্পদের মালিকের গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে এবং সাপটি তাকে ছোবল দিতে দিতে বলবে, আমি তোমার প্রিয় সম্পদ, গুপ্তধন।’ (বুখারি : ১৪০৩)


 

comment
Comments Added Successfully!